সরকারি চাকরির পাশাপাশি কি ব্যবসা করা যায়

সরকারি চাকরির পাশাপাশি কি ব্যবসা করা যায়?

আইন, নীতিমালা, সতর্কতা ও সম্ভাবনার বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি একটি সম্মানজনক, নিরাপদ ও কাঙ্ক্ষিত পেশা। অধিকাংশ মানুষই সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখেন কারণ এতে রয়েছে নিয়মিত বেতন, পেনশন, ভাতা, ছুটি, চিকিৎসা সুবিধা এবং সমাজে উচ্চ মর্যাদা। তবে বাস্তবতা হলো, শুধু বেতনের উপর নির্ভর করে অনেক সময় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে অনেকে চিন্তা করেন —
"সরকারি চাকরির পাশাপাশি কি ব্যবসা করা যায়?"

এই প্রশ্নটি সাধারণ হলেও এর উত্তর বেশ জটিল, কারণ এখানে আইনি বাধ্যবাধকতা, চাকরির নীতিমালা এবং নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। চলুন বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বুঝে নেই।

সরকারি চাকুরির নিয়মে ব্যবসা করার অনুমতি আছে কি?

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার নির্দিষ্ট আচরণ বিধিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যার নাম:

"সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯"
এই বিধিমালার ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে:

“কোন সরকারি কর্মচারী, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া, কোন ব্যবসা, বাণিজ্য বা অন্য কোন লাভজনক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।”

অর্থাৎ, সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন কোনো ব্যক্তি সরাসরি ব্যবসায় যুক্ত হতে পারবেন না, যদি না তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি পান।

সরকারি চাকরিজীবীদের যেসব ব্যবসা নিষিদ্ধ

চাকরি চলাকালীন নিচের ধরনের ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য:

  1. নিজের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে দোকান, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি পরিচালনা

  2. সরাসরি কোনো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ

  3. সরকারি পদ বা প্রভাব ব্যবহার করে ব্যবসা চালানো

  4. অফিস টাইমে ব্যবসা পরিচালনা

  5. ব্যবসা থেকে অর্জিত আয় গোপন রাখা বা কর না দেওয়া

তবে কিছু বিকল্প উপায় আছে

যদিও সরাসরি ব্যবসা করা যায় না, তবে পরোক্ষভাবে বা বিকল্প উপায়ে কিছু আয় বা উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব। নিচে কিছু আইনসম্মত ও নিরাপদ উপায়ের তালিকা দেওয়া হলো:

১. বই লেখা ও বিক্রি

আপনি যদি লেখালেখিতে আগ্রহী হন, তাহলে বই লিখে তা প্রকাশ করা আইনগতভাবে বৈধ। এটি আপনার ব্যক্তিগত দক্ষতার ফসল হিসেবে গণ্য হয় এবং আপনি এটিকে ব্যবসা বলেও চালাতে পারেন না।

২. ইউটিউব চ্যানেল বা অনলাইন কন্টেন্ট

নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা, শিক্ষা বিষয়ক টিপস, রান্না, ভ্রমণ বা প্রযুক্তি নিয়ে ইউটিউব চ্যানেল চালানো যায়। তবে শর্ত হলো:

  1. ভিডিওতে নিজের অফিস পরিচয় বা পদ ব্যবহার করা যাবে না

  2. অফিসের কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না

  3. সময় অবশ্যই অফিস টাইমের বাইরে হতে হবে

৩. পরিবারের সদস্যের নামে ব্যবসা

সরকারি চাকরিজীবী সরাসরি ব্যবসা না করলেও পরিবারের কারো (যেমন: স্ত্রী, ভাই, সন্তান) নামে ব্যবসা পরিচালিত হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আপনি:

  1. মালিকানা দাবি করতে পারবেন না

  2. ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে জড়িত হতে পারবেন না

  3. কোনো চুক্তিপত্রে নাম ব্যবহার করতে পারবেন না

৪. খামার বা কৃষি কার্যক্রম

নিজের জমিতে কৃষিকাজ, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগির খামার ইত্যাদি করা যায় যদি তা পারিবারিক উদ্যোগে পরিচালিত হয় এবং আপনি নিজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থাকেন।

৫. অনলাইন কোর্স তৈরি বা ফ্রিল্যান্সিং

যদি আপনি নিজের স্কিল দিয়ে ভিডিও কোর্স তৈরি করেন (যেমন: প্রোগ্রামিং, ডিজাইন, ইংলিশ শেখানো), তাহলে তা বিক্রি করা যায়। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিংও কিছু ক্ষেত্রে করা যায়, যদি তা:

  1. রাতের সময় করা হয়

  2. সরকারি কাজের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়

  3. নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকে

একটি টেবিলে সরলভাবে তুলনা করা যাক

আয়/ব্যবসা ধরণ সরকারি চাকরির সাথে সম্ভব? শর্ত/নিয়ম
বই লেখা ও বিক্রি                           সম্ভব                                                     নিজে লিখলে সমস্যা নেই
ইউটিউব/ফেসবুক কন্টেন্ট সম্ভব অফিস পরিচয় ব্যবহার নয়
পরিবারের নামে ব্যবসা সীমিত নিজে যুক্ত হওয়া যাবে না
ট্রেড লাইসেন্স করে দোকান নিষিদ্ধ অনুমতি ছাড়া নয়
কৃষি ও খামার সীমিত পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে হবে
ফ্রিল্যান্সিং (শর্তসাপেক্ষে) অফিস টাইমের বাইরে
ভাড়ায় বাসা/জমি দেওয়া সম্ভব প্যাসিভ ইনকাম

আপনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন যে আপনি নিয়ম ভাঙছেন না?

  1. চাকরির আচরণ বিধিমালা পড়ুন: আপনার পদ অনুযায়ী কেমন নিয়ম প্রযোজ্য, তা ভালোভাবে জেনে নিন

  2. সরাসরি ব্যবসার কোনো সিদ্ধান্তে অংশ নেবেন না

  3. যে কোনো বাণিজ্যিক উদ্যোগ নেওয়ার আগে লিখিতভাবে অনুমতি নিন

  4. আয়ের উৎস কর ফাইলে দেখান এবং গোপন করবেন না

  5. নিজের পরিচয়/পদ ব্যবহার করে কোনো প্রচার করবেন না

সরকারি চাকরির পাশাপাশি অবৈধভাবে ব্যবসা করলে কী শাস্তি হতে পারে?

  1. চাকরিচ্যুতি

  2. পদাবনতি

  3. বরখাস্ত (Suspension)

  4. সরকারি সুবিধা বাতিল

  5. দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত

  6. আইনি ব্যবস্থা

কিছু নিরাপদ ব্যবসার আইডিয়া

  1. বই/ই-বুক/গাইড বিক্রি

  2. ইউটিউব চ্যানেল (নাম/পরিচয় ছাড়া)

  3. ফ্যামিলি ফার্ম পরিচালনা (নিজের নাম ছাড়া)

  4. অনলাইন কোর্স তৈরি

  5. অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং (নিজের পরিচয় ছাড়া)

  6. নিজের ছবি ছাড়া টেক্সটভিত্তিক ব্লগ লেখা

  7. প্যাসিভ ইনকাম (ভাড়া, ডিপোজিট, ডিভিডেন্ড)


সরকারি চাকরি একটি গুরুদায়িত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ পেশা। এই চাকরি থেকে আয়ের বাইরে অতিরিক্ত উপার্জনের আগ্রহ স্বাভাবিক। তবে মনে রাখতে হবে — আপনার কোনো কাজ যেন আইন, নৈতিকতা এবং দায়িত্বের পরিপন্থী না হয়।

ব্যবসা করা অবশ্যই সম্ভব, তবে তা সচেতনতা, নিয়ম এবং সতর্কতার সঙ্গে পরোক্ষভাবে করতে হবে।

চাকরি ও সৎ পথে আয় – উভয়ই সম্ভব, যদি আপনি সতর্ক থাকেন।

Next Post Previous Post
1 Comments
  • Jahidul
    Jahidul August 6, 2025 at 10:12 PM

    আপনি কত সাল থেকে সরকারি চাকুরি করন বলে যাবেন

Add Comment
comment url